শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন
মোঃ শহিদুল্লাহ্ :
পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে বুদ্ধি হবার পর থেকেই একটা শব্দ হরহামেশাই শুনছি-শব্দটি হচ্ছে চুরি৷ গরু চুরি, ছাগল চুরি, ঘর চুরি, দোকান চুরি, পুকুর চুরি, এটা চুরি ওটা চুরি কত প্রকারেই না চুরির কথা বলা হচ্ছে ৷ জানা দরকার চুরি জিনিসটা আসলে কি৷ দন্ডবিধির ৩৭৮ ধারায় চুরির সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে: যদি কোন ব্যক্তি কারো দখল থেকে তার সম্মতি ব্যতীত কোন অস্থাবর সম্পত্তি অসাধুভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে উক্ত সম্পত্তি অপসারণ করে, নিজের দখলে রাখে, তবে সে চুরি করেছে বলে গণ্য করা হবে৷ কোন বস্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মাটির সাথে যুক্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা চুরি করার বস্তু নয়; কিন্তু যখনই তাকে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় তখনই সেটা চুরি করার বস্তু‘তে পরিণত হয়৷ যে কাজ দিয়ে মাটি থেকে বস্তু বিচ্ছিন্ন করা হয় সে কাজটি হলো চুরি৷ কোন ব্যক্তি যে অন্তরায় এর জন্যে কোন বস্তু নড়াতে পারে না সে অন্তরায়টি যদি সে অপসারণ করে বা কোন বস্তু কে বিচ্ছিন্ন করে তাহলে সে বস্তু ‘টি নাড়াচাড়া বা অপসারণ করেছে ধরে নিতে হবে; ফলে তার এ কাজটি চুরি৷ যদি কোন ব্যক্তি কোন প্রকারে কোন পশুকে স্থানান্তরিত করে তবে সে পশুটা চুরি করেছে বলে ধরে নিতে হবে৷ এসব কাজের পিছনে চুরির অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে৷ ধরা যাক রহিম করিমের একটা আম গাছ কেটে ফেলে৷ তার উদ্দেশ্য হলো করিমের জমি থেকে করিমের সম্মতি ব্যতীত গাছটি অসাধু ভাবে নিয়ে যাওয়া৷ যে মুহূর্তে রহিম গাছটা নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেটেছে সেই মুহূর্তে চুরির অপরাধ সংঘটিত হয়েছে৷ ফরিদ তার পকেটে এক প্যাকেট বিস্কুট রাখে, তার ফলে জাভেদের কুকুর ফরিদকে অনুসরণ করতে থাকে৷ এক্ষেত্রে ফরিদের উদ্দেশ্য যদি জাভেদের সম্মতি ব্যতীত জাভেদের কুকুর টমিকে অসাধুভাবে নিয়ে যাওয়া হয়; তবে সেটাই চুরি৷ আইনের ব্যাখ্যায়-শুধু চুরি (৩৭৯ দন্ডবিধি), বাসগৃহে চুরি(৩৮০ দন্ডবিধি), কর্মচারী বা চাকর কর্তৃক মালিকের দখলমুক্ত সম্পত্তি চুরি (৩৮১ দন্ডবিধি), বাসগৃহে সিঁধেল চুরি(৪৫৭/৩৮০ দন্ডবিধি), সম্পত্তি সম্বলিত আধার ভেঙ্গে উন্মুক্ত করে চুরি (৪৬১/৩৮০ দন্ডবিধি)৷ চুরির আরো অনেক সংজ্ঞা আছে যা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে আলাদা একটা বই হয়ে যাবে৷ দিনে রাতে আমরা কতই না চুরির কথা শুনি-শুনি। কেউ কারো গানের কথা চুরি করেছে, কেউ তার ছবির কাহিনী চুরি করেছে, কেউ আবার কারো মনের কথা চুরি করেছে৷ আবার নায়ক যখন বলে “চুরি করেছো আমার মনটা, হায়রে হায় মিস লংকা” অর্থাৎ মন চুরি করাও আবার একটা চুরি৷ আসলে মন কি চুরি করা যায়? চুরি কি শুধু বস্তু ‘গত ভাবেই হয়ে থাকে না অবস্থাগত ভাবেও হয়ে থাকে? চুরি শব্দটা আপেক্ষিক৷ কখনো তা নেতিবাচকভাবে আবার কখনো তা ইতিবাচক৷ কারো সম্পত্তি চুরি করলে সেটা নেতিবাচক আর যখন নায়িকা বা নায়ক একে অন্যের মন চুরি করে ভালোলাগার অনুভূতিতে সেটা ইতিবাচক৷ ইতিবাচক নেতিবাচক যাই হোক না কেন এই ভর দুপুর বেলায় যখন আমি এটা নিয়ে লিখতে বসেছি তখন আপনি হয়তো ভাবছেন খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, আমাদের চুরি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে বসেছে৷ আসলে বিশ্বাস করেন এসব নিয়ে আমার একদম লিখার ইচ্ছে ছিল না৷ কিš‘ কেন জানি আমার বিবেক আমাকে বারবার প্ররোচিত করল একটা কিছু না লিখলেই নাকি নয়৷ সে যখন দেখলো সম্প্রতি ফেসবুকে এই মর্মে পোস্ট এসেছে যে, করোনা ভাইরাসের প্রকোপে কাবু নিত্যপণ্য বাজারের অ¯ি’রতা দূর করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্তানে ১০ টাকার চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছেনে সদাশয় সরকার। এই চাল বিক্রি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে একজন ক্রেতা সর্বো”চ ৫ কেজি চাল কিনতে পারবেন৷ ১০ টাকা কেজি দরের এই চাল বাজারে আসার পর থেকেই কালোবাজারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। এই চাল বিতরণে কেউ অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যব¯’া নেওয়া হবে বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন। এরপরও থামছে না অনিয়ম এবং দুর্নীতি। প্রতিনিয়তই আসছে অনিয়মের খবর। যেখানে পঁচা চাল বিক্রি থেকে শুরু করে মারা যাওয়া ব্যক্তির নামেও চাল আত্মসাৎ করার মত ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাটা নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ১২ নং আমতলা রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নের। কেন্দুয়ার ডিলার হাবীবুর রহমান হাবীবের মাস্টার রোলে মিলেছে মৃত ব্যক্তির নামে চাল উত্তোলনের প্রমাণ। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ১২ নং আমতলা রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নের খোলা বাজারে চাল বিক্রির ডিলার হাবীবুর রহমানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে একই ইউনিয়নের চাপুর গ্রামের মৃত আঃ হামিদের নামে ১০ টাকা কেজি দরের চাল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, বিগত নয় মাস আগে মারা গেছেন আঃ হামিদ। অথচ ডিলার হাবীবুর রহমান হাবীবের জমা দেওয়া মাস্টার রোলে ৯/৩/২০২০ ইং তারিখে মৃত আঃ হামিদের টিপসহি দেখানো হয়েছে এবং চাল উত্তোলন দেখানো হয়েছে। জনমনে একটাই প্রশ্ন নয় মাস আগে মৃত ব্যক্তি কি করে ৯ মার্চ জীবিত হয়ে খোলা বাজারে চাল কিনতে এলো?
এছাড়াও ডিলার হাবীবের বিরুদ্ধে ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগও নাকি রয়েছে। মৃত আঃ হামিদের কার্ড নং ৫৩৫। অফিসে জমা দেওয়া মাস্টার রোলের ক্রমিক নং ১৪৮। এন আই ডি লাস্ট ডিজিট ৩৪৩৬।
মৃত আঃ হামিদের স্ত্রী সাফিয়া বলেছেন তার স্বামী মারা গেছে নয় মাস হয়েছে। তারপর থেকে তারা কোনদিন খোলা বাজারে দশ টাকা কেজি চাল কিনতে জাননি। এমন কি তার মৃত স্বামীর নামে চাল উত্তোলনের বিষয়টিও ডিলার হাবীব কোনদিন জানায়নি। তিনি তার মৃত স্বামীর নামে চাল উত্তোলন করায় ডিলার হাবীবের শাস্তি দাবী করেছেন।বিষয়টির সত্যতা নাকি নিশ্চিত করেছেন ৩ নং ওয়ার্ড মেম্বার আমির হামজা।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। (কোভিড-১৯) মহামারীর মোকাবেলায় কোন ভ্যাকসিন বা কোন ঔষধ এখন পর্যন্ত মানুষের হাতে নেই৷ তাই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, বিভিন্ন ¯’ানকে লক ডাউন করে রাখা- ইত্যাদি৷ আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়া চালু হওয়ার কারণে কর্মজীবী মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন৷ দেশের কোন মানুষ যাতে না খেয়ে থাকেনা সেজন্য সরকার প্রধান বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা, ত্রাণ সহায়তা প্রদানসহ ১০ টাকা কেজি মূল্যে চাল বিতরণ ইত্যাদি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷ কিš‘ এসব কর্মসূচির মহৎ উদ্দেশ্য পদে পদে বিঘিœত হ”েছ৷ কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের নীতি বিবর্জিত কর্মকা-ের জন্য ইতোমধ্যে এ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হ”েছ৷ ইতোমধ্যে কিছু অসাধু ব্যক্তির এসব খাদ্য চুরি করে নিজ দখলে রাখার প্রমাণ মিলেছে যা পরে তাদের দখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং এসব বিষয়ে আইনগত ব্যব¯’া গ্রহণ করা হয়েছে৷ তাদের নামের তালিকা এখানে দিলে হয়তো তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে৷ ইতোমধ্যে বিষয়গুলি সবাই ইলেকট্রনিক্স এবং প্রিন্টিং মিডিয়ার বদৌলতে জেনে গেছেন৷ করোনার আগ্রাসনে সবাই যখন মৃত্যুদূতের হাত থেকে নিজের জীবন রক্ষার্থে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যা”েছ ঠিক তখনই বর্তমান প্রেক্ষাপটকে মোক্ষম সময় ও সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়ে এক ধরনের অসাধু ব্যক্তি তাদের আখের গোছানোর তালে রয়েছে৷ ছোটবেলায় শুনেছিলাম দেশে প্রবাদ আছে স্বর্ণকারকে নাকি নিজ মায়ের গহনা তৈরি করতে দিলেও সে সেখান থেকেও স্বর্ণ চুরি করে৷
আসল কথা হচ্ছে “স্বভাব না যায় মলে, আর ইল্লত না যায় ধুলে”৷ যে সমস্ত অসাধু ব্যক্তি এ সব নীতি বিবর্জিত কাজ করেছে তারা অনেক আগে থেকেই তা করে আসছে, তাদের এখনই চিহ্নিত করে রাখতে হবে৷ দেশের পরিস্থিতি চিরকাল এরকম থাকবে না৷ নতুন সূর্য এক সময় উদিত হয়ে আবার তার সোনালী কিরণ ছড়িয়ে আমাদের তার আলোক”ছটায় সজীবতার স্পর্শ এনে দেবে৷ এসব চিহ্নিত ব্যক্তিদের আজ থেকেই পৃথক করে রাখতে হবে৷ যাতে করে ভবিষ্যতে তারা আবার আমাদের মাঝে নতুন ছদ্মবেশে এসে তার স্বভাব সিদ্ধ এ সব অসাধু কাজের পাল্লা ভারী করার সুযোগ যেন আর না পাই-‘চুরি চুরি চুপকে চুপকে’৷